রক্ত কণিকা কি ও কত প্রকার | লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা, ও অণুচক্রিকা কি এবং এদের কাজ

 

রক্ত কণিকা কি ও কত প্রকার | লোহিত রক্ত কণিকা, শ্বেত রক্ত কণিকা, ও অণুচক্রিকা কি এবং এদের কাজ

রক্তকণিকা কি

রক্তরসে ভাসমান অবস্থায় যে কোষগুলো বিদ্যমান থাকে, তাদেরকে রক্ত কণিকা বলে। রক্তে তিন ধরনের কণিকা থাকে, যথা - লোহিত রক্ত কণিকা (Erythrocyte), শ্বেত রক্ত কণিকা (Leucocyte) এবং অণুচক্রিকা (Thrombocyte)।

(i) লোহিত রক্ত কণিকা (R.B.C) কি

লোহিত রক্ত কণিকা দ্বিঅবতল এবং চাকতির মত। স্তন্যপায়ীর রক্তের লোহিত কণিকা দ্বিঅবতল গোলাকার এবং নিউক্লিয়াসবিহীন। উটের লোহিত কণিকা নিউক্লিয়াসযুক্ত। এরা স্থিতিস্থাপক প্লাজমা পর্দা পরিবেষ্টিত স্পঞ্জি সাইটোপ্লাজম দ্বারা গঠিত। এদের ব্যাস ৫.৫–৮.৮ মাইক্রোন এবং পুরুত্ব ২ মাইক্রোন। স্ত্রীলোকের প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে ৪৫ লক্ষ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৫০ লক্ষ লোহিত কণিকা থাকে। তবে শিশুদের ৬০-৭০ লক্ষ থাকে।

লোহিত রক্ত কণিকা (Erythrocyte), শ্বেত রক্ত কণিকা (Leucocyte) এবং অণুচক্রিকা (Thrombocyte)।

এর রাসায়নিক উপাদানগুলো যথাক্রমে হিমোগ্লোবিন, প্রোটিওলিপিড, ইউরিয়া, অ্যামাইনো এসিড, ক্রিয়েটিন, অজৈব ফসফেট ইত্যাদি। হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির জন্য এরা লাল বর্ণ ধারণ করে। ভ্রূণাবস্থায় যকৃত, প্লীহা ও থাইমাস থেকে এবং ২০ বছর পর্যন্ত অস্থিমজ্জার হিমোসাইটোব্লাস্ট কোষ থেকে লোহিত কণিকা উৎপন্ন হয়। জীবনের বাকী সময় হিউমেরাস, ফিমার, কশেরুকা অস্থির শেষ প্রান্ত থেকে উৎপন্ন হয়। এদের জীবনকাল প্রায় ৪ মাস।

লোহিত রক্ত কণিকার কাজ

  • ১. অক্সিহিমোগ্লোবিন হিসেবে ফুসফুস থেকে দেহকোষে O, পরিবহন করে।
  • ২. দেহকোষে উৎপন্ন CO, শ্বসন অঙ্গে বহন করে আনে।
  • ৩. হিমোগ্লোবিন ও বাইকার্বনেট বাফার দ্বারা অম্ল-ক্ষারের সাম্যতা বজায় রাখে
  • ৪. এসব রক্ত কণিকা রক্তে বিলিরুবিন ও বিলিভার্ডিন উৎপাদন করে।

(ii) শ্বেত রক্ত কণিকা কি (W.B.C)

নির্দিষ্ট আকৃতিবিহীন, নিউক্লিয়াসযুক্ত, বর্ণহীন রক্তকোষগুলোকে শ্বেত রক্ত কণিকা বলে। এই কণিকাগুলো লোহিত কণিকার তুলনায় বড় কিন্তু সংখ্যায় অনেক কম থাকে। পূর্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে প্রায় ৬,০০০–১১,০০০টি শ্বেত রক্ত কণিকা থাকে। শ্বেত রক্ত কণিকা নিউক্লিওপ্রোটিন সমৃদ্ধ এবং গ্লাইকোজেন, লিপিড, কোলেস্টেরল, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড ও বিভিন্ন প্রোটিওলাইটিক এনজাইম বহন করে। আকৃতি ও প্রকৃতিতে এরা ২ প্রকার। যথা – (ক) দানাদার শ্বেত রক্ত কণিকা ও (খ) অদানাদার শ্বেত রক্ত কণিকা।

(ক) দানাদার শ্বেত রক্ত কণিকা (Granulocyte)

প্রায় ৭৫% শ্বেত রক্ত কণিকার নির্দিষ্ট কোন আকৃতি নেই। এদের দুই বা অধিক লোবযুক্ত বড় নিউক্লিয়াস থাকে। সাইটোপ্লাজমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানা থাকে বলে এদেরকে granulocyte বলে। এ ধরনের কণিকা অস্থিমজ্জা থেকে তৈরি হয়। নিউক্লিয়াসের আকৃতি অনুসারে এদেরকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা(i) নিউট্রোফিল, (ii) ইওসিনোফিল ও (iii) বেসোফিল।

(i) নিউট্রোফিল : সঞ্চালনরত রক্তের ৬০ – ৭০% হল নিউট্রোফিল। এদের ব্যাস ১২ – ১৫ মাইক্রোন এবং নিউক্লিয়াস সাধারণত ৩ লোব বিশিষ্ট। এদের জীবনকাল ২–৪ দিন। রঞ্জক প্রয়োগে সাইটোপ্লাজম বেগুনী রং ধারণ করে।

(ii) ইওসিনোফিল : রক্তের স্বাভাবিক অবস্থায় এদের সংখ্যা নিউট্রোফিলের চেয়ে কম অর্থাৎ ২-৪%। এদের ব্যাস ১২-১৫ মাইক্রোন এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ৩ লোব বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস উপস্থিত। রঞ্জক প্রয়োগে সাইটোপ্লাজম লাল বর্ণ ধারণ করে।

(iii) বেসোফিল : রঞ্জক প্রয়োগে সাইটোপ্লাজম নীল বর্ণ ধারণ করে। এদের ব্যাস ৮-১০ মাইক্রোন। নিউক্লিয়াস নির্দিষ্ট খণ্ডে বিভক্ত নয়। W.B.C এর মাত্র ১% বেসোফিল।

(খ) অদানাদার শ্বেত রক্ত কণিকা

এ প্রকার শ্বেত রক্ত কণিকার সাইটোপ্লাজম দানাবিহীন এবং নিউক্লিয়াসটি অপেক্ষাকৃত বৃহদাকার ও অখণ্ডায়িত। এরা দু'প্রকারের। যথা- (i) মনোসাইট ও (ii) লিম্ফোসাইট। লিম্ফনোড, টনসিল, প্লীহা ইত্যাদি অঙ্গে এরা তৈরি হয়। এদের জীবনকাল লোহিত রক্ত কণিকার চেয়ে অনেক কম।

(i) মনোসাইট : এরা সর্বাপেক্ষা বৃহৎ আকৃতির লিউকোসাইট। প্রাথমিক অবস্থায় গোলাকার বা ডিম্বাকার থাকে এবং পরিণত অবস্থায় বৃক্কের ন্যায় বা অশ্বক্ষুরাকৃতি ধারণ করে। তবে এদের নিউক্লিয়াস খুবই ছোট। প্রতিঘন মিলিমিটার রক্তে এদের সংখ্যা ১০০-৬০০।

(ii) লিম্ফোসাইট : এদের সাইটোপ্লাজমের পরিমাণ কম থাকে। তবে নিউক্লিয়াসটি সাইটোপ্লাজমের অনেক স্থান দখল করে থাকে।

মানুষের রক্তে উপস্থিত বিভিন্ন প্রকার শ্বেত রক্তকণিকা

শ্বেত রক্ত কণিকার কাজ

  • (i) এন্টিবডি সৃষ্টি করে দেহের রোগ প্রতিরোধ করে।
  • (ii) ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় রক্তে প্রবিষ্ট জীবাণু সরাসরি গ্রাস করে ধ্বংস করে
  • (iii) দানাদার বেসোফিল শ্বেত কণিকা হেপারিস ক্ষরণ করে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা প্রদান করে।
  • (iv) ইওসিনোফিল শ্বেত কণিকা হিস্টামিন নিঃসৃত করে এলার্জি বিরোধী কাজে সহায়তা করে।

(iii) অণুচক্রিকা কি

অতি ক্ষুদ্রাকার উভয় প্রান্ত সুচালো, রঙবিহীন, নিউক্লিয়াসবিহীন, DNA বিহীন কোষগুলোর নাম অণুচক্রিকা। তবে এতে সক্রিয় এনজাইম ও মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। এদের ব্যাস ৩u – ৫´ পর্যন্ত প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে এদের সংখ্যা প্রায় আড়াই লক্ষ। এদের জীবনকাল ৫-১০ দিন। অণুচক্রিকায় আমিষ ও প্রচুর পরিমাণে সেফালিন নামক ফসকোলিপিড থাকে। এদের উৎপত্তি সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে।

অণুচক্রিকার কাজ

  • ১. রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে।
  • ২. ক্ষতিগ্রস্ত রক্ত জালিকা মেরামত করে।
  • ৩. সেরাটোনিন নামক রাসায়নিক পদার্থ উৎপন্ন করে যা রক্তনালীর সংকোচন ঘটিয়ে রক্তপাত হ্রাস করে।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ