নেতৃত্ব কি, কাকে বলে | নেতৃত্বের গুরুত্ব, বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলি ও প্রকারভেদ

যে কোন ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনের জন্য নেতৃত্ব অপরিহার্য। সঠিক ও সফল নেতৃত্ব ছাড়া কখনই প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভবপর হয় না। সঠিক নেতৃত্বের ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠান যেমন লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়, তেমনি নেতৃত্বের অভাবে প্রতিষ্ঠানের কর্মী, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও অন্যান্য আয়োজনসমূহ ব্যর্থ হয়ে যায়। আজকাল নেতৃত্বকে তাই যে কোন সমাজ বা সংগঠনে আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

নেতৃত্ব কি, কাকে বলে | নেতৃত্বের গুরুত্ব, বৈশিষ্ট্য, কার্যাবলি ও প্রকারভেদ

নেতৃত্ব কি

কোন দল বা গোষ্ঠীর আচরণ ও কাজকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য অর্জনের প্রচেষ্টাকেই নেতৃত্ব বলা হয়। যিনি এ দায়িত্ব পালন করেন তাকে নেতা (Leader) বলা হয়। নেতা নামক ব্যক্তিটি তার দলকে পরিচালিত করার জন্য অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেন বা সঠিক পথনির্দেশনা দেন। কর্মী বা দলকে পরিচালিত করাই নেতৃত্বের মূলকথা। শব্দগত অর্থে, ইংরেজি 'Lead' হতে 'Leadership' শব্দ এসেছে, যার বাংলা অর্থ হল নেতৃত্ব। 'Lead' শব্দের অর্থ হল পথ দেখানো, চালিত করা (To conduct), আদেশ করা (To direct) ইত্যাদি। তাই নেতৃত্ব বলতে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের জন্য অধীনস্থ লোকদের পরিচালনা করার এমন কৌশলকে বুঝায়, যাতে দলীয় সদস্যরা তাদের সম্ভাব্য সর্বাধিক সামর্থ্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তৎপর হয়।

নেতৃত্ব কাকে বলে এবং নেতৃত্ব নিয়ে উক্তি

নেতৃত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন চিন্তাবিদ তাদের নিজস্ব সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের প্রদত্ত কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হল

নিউস্টোম এবং কিথ ডেভিস (Newstorm and Keith Davis) এর মতে, “নেতৃত্ব হল উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্তে অন্যান্য লোকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহিত ও সাহায্য করার একটি প্রক্রিয়া।" (Leadership is the process of encouraging and helping others to work enthusiastically toward objectives.)

কুঞ্জ এবং ও'ডোনেল (Koontz. and O'Donnell) এর ভাষায়, “নেতৃত্ব হল জনগণকে প্রভাবিত করার এমন একটি কলা বা প্রক্রিয়া, যাতে তারা দলীয় লক্ষ্য অর্জনে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়।" (Leadership is tite art or process of influencing people so that they will strive willingly and enthusiastically toward the achivement of group goals.)

এম. জে. গানোন (M. J. Gannon) এর মতে, “নেতৃত্ব হল একটি প্রভাব বিস্তারকারী প্রক্রিয়া, যেখানে নেতা একটি নির্দিষ্ট কার্যধারা সম্পাদন করতে তার অধীনস্থদের অবশ্যই প্ররোচিত বা প্রভাবিত করে।” (Leadership is an influence process. The leader must persuade or influence his or her subordinates to complete a particular course of action.)

হিকস এবং গুলেট (Hicks and Gullet) এর ভাষায়, “নেতৃত্ব হল যে কোন ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট নির্দেশনা দানের ক্ষেত্রে অন্যান্য আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য।" (Leadership is the ability to influence thought whatever means the behaviour of others in a particular direction.)

R. M. Stogdill বলেছেন, “প্রত্যাশা পূরণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য একটি কাঠামোর সৃষ্টি ও সংরক্ষণ হল নেতৃত্ব।” (Leadership is the initiation and maintenance of structure in expectation and interaction.)

ডি. ই. ম্যাকফারল্যান্ড (D. E. Mcfarland) এর মতে, “নেতৃত্ব হল আন্তঃব্যক্তিক প্রভাবের এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নেতা উদ্দেশ্য নির্ধারণে অন্যদের কার্যাবলিকে প্রভাবিত করে।

David H. Holt এর মতে, “নেতৃত্ব হচ্ছে অন্যদেরকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়া, যাতে কাঙ্ক্ষিত উপায়ে সাংগঠনিক উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়।”

নেতৃত্বের গুরুত্ব

মূলত ব্যবস্থাপনা হল এক বিশেষ প্রকারের নেতৃত্ব দান; কর্মীদেরকে একত্রিত করার ক্ষমতাই হল নেতৃত্ব। নিম্নে ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্বের গুরুত্ব আলোচনা করা হল।

১. সংঘবন্ধতা সৃষ্টি (Creating unity) : ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত জনশক্তিকে সংঘবদ্ধভাবে পরিচালনা করা। কারণ সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যতীত কখনও প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জন করা সম্ভবপর হয় না। প্রতিষ্ঠানে কার্যকর মানের নেতৃত্ব থাকলে তাকে ঘিরে অধস্তন জনশক্তি সংঘবদ্ধ ও আবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, নেতৃত্ব যত বেশি শক্তিশালী হয়, সংগঠনও তত বেশি শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে থাকে।

২. দলবদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার (Emphasizing group effort) : দলীয় প্রচেষ্টাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে পরিচালনা করাই মূলত নেতার কাজ। এরূপ প্রচেষ্টা বিশেষ করে নেতার নিজস্ব গুণ ও কর্মদক্ষতার উপর বহুলাংশে নির্ভর করে। সাধারণত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের মান দুর্বল হলে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত জনবলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং দলবদ্ধ প্রচেষ্টা দারুণভাবে ব্যাহত হয়। সুতরাং প্রতিষ্ঠানে দলবদ্ধ প্রচেষ্টা সৃষ্টি ও জোরদারকরণের ক্ষেত্রে সুদক্ষ নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই বললেই চলে।

৩. নমনীয়তা বৃদ্ধি (Increasing flexibility) : সাধারণত পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনাকে অনেক সময়ই গৃহীত পরিকল্পনা ও কর্ম পদ্ধতির পরিবর্তন আনয়ন করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে যে কোন ধরনের পরিবর্তন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীরা সহজে মেনে নিতে চায় না। এমতাবস্থায়, যোগ্য নেতৃত্ব এক্ষেত্রে কর্মীদের মনোভঙ্গিতে সহজেই পরিবর্তন এনে প্রাতিষ্ঠানিক নমনীয়তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৪. সম্পর্কের উন্নয়ন (Developing relationship) : প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের উপর সহযোগিতার বিষয়টি বহুলাংশে নির্ভরশীল হয়। ব্যবস্থাপনা দুর্বল হলে তা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। ফলে তা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে ও যে কোন সমস্যার সহজ সমাধানে ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায়, যোগ্য নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় প্রকার সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করে ব্যবস্থাপনাকে সবার নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

৫. শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক (Labour management relations) : যেহেতু উত্তম নেতৃত্বের মাধ্যমে কর্মীদের দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাদেরকে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করা সম্ভবপর হয়, তাদের যে কোন সমস্যা দ্রুততার সাথে সমাধানের উদ্যোগ করা হয় এবং তাদের কার্যক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ প্রদান করা হয়; সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানে শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।

৬. সহযোগিতার উন্নয়ন (Developing co-operation) : যে কোন ব্যবসায় সংগঠনে কর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া লক্ষ্যার্জন সম্ভবপর হয় না। কার্যকর নেতৃত্ব সংগঠনের অভ্যন্তরে এরূপ সহযোগিতা উন্নয়নে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। নেতৃত্বকে ঘিরেই জনশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতায় কার্যসম্পাদন করে। নেতাই অধস্তনদের মধ্যকার অনৈক্য ও ভুল বুঝাবুঝি দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে চলার অনুপ্রেরণা যোগায়।

৭. লক্ষ্যার্জনে সহায়তা দান (Helping in achievement of goal) : কার্যকর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ নেতৃত্ব হল এমন একটি কৌশল, যার ফলশ্রুতিতে দলীয় সদস্যরা তাদের সর্বোচ্চ তৃত্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনে সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে তৎপর হয়। প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের গুণসম্পন্ন ব্যবস্থাপক থাকলে তার বা তাদের প্রচেষ্টায় জনশক্তির ধ্যানধারণা ও কর্মপ্রচেষ্টা নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে পরিচালিত হয়ে থাকে।

৮. মনোবল উন্নয়ন (Developing morale) : ব্যবস্থাপনার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল কর্মীদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করে স্বতঃস্ফূর্ত কাজ আদায় করা। এক্ষেত্রে যোগ্য নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নেতৃত্ব যোগ্য হলে তার অধীনে কাজ করতে কর্মীরা সবসময়ই উৎসাহ বোধ করে এবং তাদের মনোবলও উন্নত থাকে। কর্মীদের উচ্চ মনোবল ও উত্তম কারবারি পরিবেশ সৃষ্টিতেও নেতৃত্ব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৯. ফলপ্ৰদতা বৃদ্ধি (Increasing effectiveness) : যোগ্য নেতৃত্বের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সকল কাজের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নেতৃত্ব একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য কর্মীদের মাঝে ভালো কাজের পুরস্কার দেওয়া এবং তার কাজকে প্রশংসা করা হয়, বিধায় কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। সংগঠনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে কার্যক্ষেত্রে ভালো ফলাফল লাভ করা সম্ভব হয়।

১০. কর্তৃত্ব প্রয়োগে সহায়তা দান (Helping in application of authority) : সাধারণত একজন যোগ্য নেতা তার অধীনস্থ কর্মীদের প্রকৃতি, যোগ্যতা, চাওয়া পাওয়া ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকেন। ফলে কিভাবে, কাকে, কোন দায়িত্ব, কতটুকু প্রদান করলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভবপর হবে তা নেতা যথাযথভাবেই নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। তদুপরি, কতটুকু কর্তৃত্ব কোথায় প্রয়োগ করলে কাজ উদ্ধার ও লক্ষ্যার্জন হবে তাও নেতা অতি সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। অতএব নেতৃত্ব কৌশল, ব্যবস্থাপনাকে যথাযথ কর্তৃত্ব প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নেতৃত্বের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য

সব ধরনের নেতৃত্বকে সাধারণভাবে বিশ্লেষণ করে নেতৃত্বের বা যোগ্য নেতৃত্বের যেসব প্রকৃতি বা রূপ বা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হল।

১. অধস্তনদের সম্পর্কে ধারণা (Clear idea about the subordinates) : নেতৃত্ব হল অধস্তনদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে পরিচালনা করার কৌশল। এরূপ কৌশল প্রয়োগে অধস্তনদের আবেগ, অনুভূতি ও সমস্যা সম্পর্কে নেতার প্রয়োজনীয় ধারণা থাকতে হয়। অধস্তনরা তাদের নেতাকে পথপ্রদর্শক ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পেতে চায়। তাই অধস্তনদের মান, দক্ষতা, চাওয়াপাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে নেতার জানা থাকলেই শুধুমাত্র অধস্তন তথা অনুসারীদের সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভবপর হয়।

২. সর্বজনীনতা (Universality) : সংগঠন ও দলীয় প্রচেষ্টা কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। তাই নেতৃত্বের ধারণার মধ্যে সংঘাত থাকলে বা মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলে তা সকল সমাজ, সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানে সর্বজনীনভাবে প্রয়োগ করা যায় না। তাই সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে নেতৃত্ব প্রয়োগ করতে হবে।

৩. দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদন (Performance with efficiency) : নেতৃত্বের মাধ্যমে সৃষ্ট আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সম্পর্কের মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ শ্রমব্যবস্থাপনা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে শ্রমিক-কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্তব্য সম্পাদনে মনোনিবেশ করে। ফলে দক্ষতার সাথে দলীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জন করা সম্ভব হয়।

8. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা (To maintain discipline) : নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিকভাবে কার্য পরিচালনার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত সকল শ্রমিক কর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে সহযোগিতার সূত্রে আবদ্ধ হয়। এমতাবস্থায়, কারও পক্ষে পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ফলে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মীর কাজের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

৫. অনুসারীদের উপস্থিতি (Presence of followers) : নেতৃত্বের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল অনুসারীদের উপস্থিতি। নেতার আদেশ নির্দেশ মেনে চলা বা তার কর্তৃত্ব প্রয়োগের জন্য অনুসারী থাকতেই হয়। অনুসারী না থাকলে নেতার নেতৃত্বের প্রসঙ্গটিও অবান্তর হয়ে যায়।

৬. কতিপয় গুণের সমষ্টি (Sum of qualities) : নেতৃত্ব আসলে কতিপয় গুণের সমষ্টি। একজন ভালো নেতার মধ্যে অবশ্যই কতকগুলো গুণ থাকতে হয়। এগুলো হল সততা, বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক স্নায়ুবিক শক্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহস ও ইচ্ছাশক্তি, যোগাযোগ দক্ষতা, কৌশল ইত্যাদি।

৭. প্রভাবিতকরণ (Influencing) : নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হল প্রভাবিতকরণ। অনেক বিশেষজ্ঞ নেতৃত্বকে অধস্তনদের আচরণ ও কার্যাবলির উপর প্রভাব বিস্তারের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বলতে গেলে নেতৃত্বের সফলতা অধস্তনদের প্রভাবিতকরণের ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল।

৮. পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিবিধান (Adjustment with the situation) : যোগ্য নেতৃত্বকে সর্বদা বিরাজমান পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিবিধান করে চলতে হয়। নেতা যে বিশেষ পরিস্থিতিতে কাজ করেন সে পরিবেশ পরিস্থিতিই নেতৃত্বকে সর্বাধিক প্রভাবিত করে। সে কারণে নেতাকে প্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি এমনভাবে সৃষ্টি করতে হবে যাতে নেতৃত্ব সফল হতে পারে।

৯. গ্রহণযোগ্যতা (Acceptability) : গ্রহণযোগ্যতা নেতৃত্বের সফলতার পূর্বশর্ত। নেতাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তার অনুসারীদের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে হয়। অনুসারীরা নেতাকে গ্রহণ না করলে নেতৃত্ব তার কার্যকারিতা হারায়। সুতরাং নেতাকে সর্বজন স্বীকৃতি দিবে এটাই নেতার একমাত্র বৈশিষ্ট্য।

১০. কার্যকর যোগাযোগ (Effective communication) : যোগ্য নেতৃত্ব সবসময় অধস্তনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যোগাযোগ ছাড়া ফলপ্রসূ নেতৃত্ব সম্ভব নয়। কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যমে নেতা তার আদেশ নির্দেশ, চিন্তাভাবনা অধস্তনদের নিকট প্রেরণ করেন এবং তাদের প্রতিক্রিয়া, মনোভাব ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হন।

১১. অধস্তনদের আনুগত্য (Loyalty of the subordinates) : নেতৃত্ব আনুগত্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অধস্তনদের আনুগত্য না থাকলে নেতৃত্ব কখনই সফলকাম হতে পারে না। এরূপ আনুগত্য স্বেচ্ছামূলক হোক বা বাধ্যতামূলক হোক নেতৃত্বের পক্ষে অধস্তনদের আনুগত্য লাভ প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনে অপরিহার্য। অবশ্য নেতা যদি তার আচরণ ও গুণাবলির মাধ্যমে অধস্তনদের আস্থা ও শ্রদ্ধা আদায় করতে পারেন সেক্ষেত্রে অধস্তনদের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য লাভ সম্ভব হয়। ফলে নির্দ্বিধায় কর্মীরা নেতার আদেশ নির্দেশ পালনে বাধ্য থাকে।

১২. অধস্তনদের প্রেষণাদীন (Motivating subordinates) : নেতৃত্বের সাথে উৎসাহ দান ও প্রভাবিতকরণের যোগসূত্র রয়েছে। যোগ্য নেতা তার ব্যক্তিত্ব ও আচরণের মাধ্যমে অধস্তনদের মনে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে কাজ আদায়ের চেষ্টা করেন। এজন্য নেতাকে আর্থিক ও অনার্থিক বিভিন্ন প্রেষণা দানের পদ্ধতি ও এর কার্যকারিতা সম্পর্কে অবগত থাকতে হয়। তাই যোগ্য নেতৃত্ব অধস্থনদের জন্য একটি অতি আবশ্যক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।

১৩. ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উপস্থিতি (Presence of power and authority) : নেতৃত্বের সাথে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। নেতার আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কর্তৃত্বের কারণে অধস্তনরা তার অনুসরণ করে। নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হলে অধস্তনরা বাধ্যতামূলকভাবে তার আনুগত্য প্রকাশ করে। তবে নেতা যদি তার আচার-আচরণ ও গুণাবলির মাধ্যমে অধস্তনদের মনে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে পারেন সেক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং অধস্তনদের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য লাভ করা সম্ভব হয়।

১৪. ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা (Mentality of taking risk) : নেতৃত্বের সাথে ঝুঁকি সম্পর্কযুক্ত। কারণ ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব সহ-সম্বন্ধযুক্ত গণ্য হয়ে থাকে। নেতা যেহেতু কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন ফলে তাকে কাজের দায়িত্ব এবং ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়। যে কোন নতুন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব যেহেতু নেতৃত্বের উপর থাকে ফলে যে কোন ঝুঁকির উদ্ভব হলে নেতা তা মানতে সবসময়ই বাধ্য থাকে।

১৫. সাংগঠনিক পরিবর্তন আনয়নের ক্ষমতা (Ability to bring changes in the organization) : যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংগঠনের উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের উপায় বের করাই হলো নেতার অন্যতম একটি ক্ষমতা। সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নেতা তার ক্ষমতা বলে সংগঠনে যে কোন ধরনের পরিবর্তন করতে পারেন। সুতরাং সংগঠনের স্বার্থে যে কোন ধরনের পরিবর্তনই হল নেতার বৈশিষ্ট্য।

১৬. দায়িত্ব গ্রহণের প্রবণতা (Tendency to shoulder responsibility) : নেতাকে সংগঠনের ন্তরীণ ও বাহ্যিক সকল দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের সবাইকে দায়িত্ব দেওয়া হয় না। কেবল নেতার উপর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। নেতা তার অধীনস্থ কর্মী এবং নিজের মেধা, মননশীলতা দ্বারা অর্পিত দ্বায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাই দায়িত্ব গ্রহণের প্রবণতা নেতৃত্বের অন্যতম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

১৭. আত্মসচেতনতা (Self-awareness) : নেতাকে সবাই সম্মান করবে, তাকে অনুসরণ করবে এবং তার অনুসারীরা তার ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ, চিন্তাভাবনা ইত্যাদি অনুসরণ করে। সুতরাং নেতাকে উপরিউক্ত বিষয়ের প্রতি অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। নেতার আদর্শ সবাইকে প্রভাবিত করে বিধায় তাকে অবশ্যই সকল বিষয় সচেতনতার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। কারণ নেতা যদি সচেতন না হয় তাহলে সহকর্মীরা কাজে উৎসাহ পাবে না।

নেতৃত্ব বা নেতার কার্যাবলি

অধীনস্থদের প্ররোচিত করে সাংগঠনিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যার্জনের নিমিত্তে নেতাকে বিশেষ কতকগুলো কার্যসম্পাদন বা দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে নেতার এসব কার্যাবলি দু'ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায়। যথা:

  • ক. সাংগঠনিক কার্যাবলি এবং
  • খ. আনুষঙ্গিক কার্যাবলি

ক. সাংগঠনিক কার্যাবলি (Organizational functions)

মূলত যে সমস্ত বিধিসম্মত দায়িত্ব ও কর্তব্য নেতা সম্পাদন করে থাকে তাই সাংগঠনিক কার্যাবলি নামে অভিহিত হয়। নিম্নে একজন নেতার বিভিন্ন ধরনের সাংগঠনিক কার্যাবলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

        ১. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ (Preparing plan and formulating policy) : ভবিষ্যতে কি কাজ করতে হবে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা সম্পাদনে প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল নির্ধারণ করা নেতার প্রথম ও প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মূলত পরিকল্পনা ও নীতির আওতায় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কার্যাবলি এবং কার্যসম্পাদনের কৌশল নির্ধারিত হয়। এতে সুশৃঙ্খলভাবে কার্যসম্পাদন করা সম্ভব হয়। তাই নেতা সর্বাগ্রেই সাংগঠনিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণের কাজটি করে থাকেন।

        ২. উপযুক্ত সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি (Preparing proper organizational structure) : প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক কাঠামো বিন্যাস নেতাকেই করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের কাজের বিভাগীকরণ, স্তর নির্ধারণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য সংজ্ঞায়িতকরণ ও বন্টন এবং বিভিন্ন স্তর ও বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ এরূপ কাজের আওতাভুক্ত।

        ৩. কর্মী নির্বাচন ও মানে (Selection of employees and their development): নেতাকেই যোগ্য অধস্তন সংগ্রহ ও তার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় কর্মব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। অধস্তনদের কর্মদক্ষতার উপরই নেতার কাজের সাফল্য নির্ভর করে। তাই কর্মী নির্বাচন, প্রশিক্ষণ এবং তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগানো নেতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজ।

        8. নির্দেশ দান (Directing) : যথাসময়ে নির্দেশ দানের উপর কাজের সাফল্য নির্ভর করে। নেতাকে সবসময়ই সময় বুঝে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করতে হয়। পরিকল্পনার আলোকে যোগাযোগ বজায় রেখে নির্দেশ দান, কার্যকর পরিচালনা ও অনুসরণের উপর অধস্তনদের কার্য সাফল্য নির্ভর করে।

        ৫. কার্যকর তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন (Effective supervision and co-ordination) : অধস্তন কর্মীদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে হলে শুধুমাত্র নির্দেশ দিলেই চলে না। নির্দেশ অনুযায়ী তারা কাজ করছে কি না বা কার্যক্ষেত্রে কোন ভুল হচ্ছে কি না তা দেখা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কার্যকর তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগের কাজের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় করাও নেতার গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

        ৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Decision making) : যে কোন জটিল স্থিতিতে নেতাকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। নেতা এক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে উদ্ভূত সমস্যা বা জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। সুতরাং কারবার প্রতিষ্ঠানের যে কোন কাজের বা দলগত সমস্যা মোকাবিলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নেতৃত্বের বা নেতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

        ৭. উৎসাহ প্রদান (Inspiring) : প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের উৎসাহ প্রদান করা নেতার অন্যতম কাজ। নেতা কর্মীদের উপর পঠনমূলক প্রভাব বিস্তার করে তাদেরকে দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদনে অনুপ্রাণিত করেন।

        ৮. সংহতি বিধান (Integration) : নেভার একটি অন্যতম প্রধান কাজ হল তার অনুসারীদের প্রচেষ্টাকে সুসংহতকরণের মাধ্যমে সেগুলোকে সাংগঠনিক লক্ষ্য অর্জনের দিকে প্রবাহিত করা। নেতা দলীয় প্রচেষ্টাকে সুসংহত করেন, যা ছাড়া সাধারণ লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে।

        ৯. কার্যকর নিয়ন্ত্রণ (Effective controlling) : নেতার আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সাংগঠনিক কাজ পরিকল্পিতভাবে সম্মদিত হচ্ছে কি না তা দেখা ও প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এজন্য বিচ্যুতি নিরূপণ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনীমূলক ব্যবস্থা কি হতে পারে তা নেতাকেই নির্ধারণ করতে হয়। প্রয়োজনে সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে যথাযথ নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা আরোপের প্রয়োজন পড়ে।


খ. আনুষঙ্গিক কার্যাবলি (Accessory function)

সাধারণত নেতা সংগঠন বহির্ভূত অথচ প্রয়োজনীয় অন্য যেসব কার্যসম্পাদন করে থাকে সেগুলোকেই আনুষঙ্গিক কার্য বলা হয়। এসব কাজ তথা আনুষঙ্গিক কাজগুলো একজন নেতা মূলত সাংগঠনিক লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তেই সম্পাদন করে থাকেন। নিম্নে এগুলো তুলে ধরা হল।

        ১. আস্থা সৃষ্টি (Creating enthusing) : নেতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল অধস্তন জনশক্তি ও সংশিষ্ট সকল পক্ষের কাছে প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্ব সম্পর্কে আস্থা সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে নেতা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ও চারিত্রিক গুণাবলির মাধ্যমে সংশিষ্ট সকলের আস্থা অর্জন করেন। নেতার প্রতি অধস্তনদের আস্থা না থাকলে কার্যক্ষেত্রে তারা কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হয় না। পক্ষান্তরে, নেতার প্রতি অধস্তনদের কার্যকর মানের আস্থা বজায় থাকলে তারা যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আগ্রহী এবং নেতার আদেশ বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করে। ফলে সফলতার সাথে সাংগঠনিক উদ্দেশ্য অর্জিত হয়।

        ২. দলগত প্রচেষ্টার উন্নয়ন (Boasting team spirit) : সাংগঠনিক কাজ দলবদ্ধ প্রচেষ্টার উপর নির্ভরশীল। নেতা যদি নিজেই সব কাজ করেন এবং অধস্তনদের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন, তবে তার পক্ষে কাঙ্খিত ফল লাভ করা সম্ভবপর হয় না। তাই নেতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল দলবদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা।

        ৩. যোগাযোগ (Communication) : অধস্তনদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন নেতার অন্যতম কাজ। এর মাধ্যমে নেতা সাংগঠনিক নীতি এবং তার নির্দেশাবলি উপযুক্ত স্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হন। ফলে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়।

        ৪. বিরোধ নিষ্পত্তি (Settlement of dispute) : নেতাকে দলের সদস্যদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হয়। এজন্য তাকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে কোনরূপ মতভেদ দেখা দিলে নেতা উভয়পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। এতে পারস্পরিক বিরোধের অবসান ঘটে।

        ৫. নিরাপত্তার ব্যবস্থাকরণ (Providing security) : নেতাকে তার অনুসারীদের যে কোন বিপদাপদ ও প্রতিকূল অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়াতে হয় এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়। এর ফলে তারা নিশ্চিন্তে দায়িত্ব পালন করতে পারে। ফলে সহজে প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়।

        ৬. মনোবল বৃদ্ধি (Increasing morality) : কর্মীরা যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয়, সেজন্য অনার্থিক বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার ব্যবস্থা নেতাকেই করতে হয়। নেতা কর্মীদের অভাব অভিযোগ ও চাহিদার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে উদ্দেশ্যের আলোকে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এতে কর্মীদের মনোবল বাড়ে। তাছাড়া কার্যকর তত্ত্বাবধান, সুষ্ঠু যোগাযোগ ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও কর্মীদের মনোবল উন্নয়নে নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

        ৭. উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা (Establishment of objectives) : মূলত উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সমুদয় কার্যাবলি পরিচালিত হয়। তাই নেতা সর্বপ্রথমে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা করে দলীয় কর্মী বা সদস্যদের অবহিত করেন। অতঃপর দলীয় সদস্যরা উক্ত উদ্দেশ্যের আলোকে নেতার নির্দেশনামূলক যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এতে উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়।

নেতৃত্বের প্রকারভেদ

বিভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব সম্পর্কে নিয়ে আলোচনা করা হল :

ক. আনুষ্ঠানিক বিচারে (Basing informalities)

সংগঠন কাঠামোতে নেতৃত্বের একটি রূপরেখা নির্দিষ্ট করা থাকে। আবার এর বাইরেও জনশক্তির ইচ্ছা ও পছন্দের আলোকে সাংগঠনিক নিয়ম আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও নেতা নির্দিষ্ট হতে পারে। এরূপ বিচারে নেতৃত্বকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

        ১. আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (Formal leadership) : আনুষ্ঠানিক সংগঠন কাঠামোতে পদমর্যাদা হতে যে নেতৃত্বের সৃষ্টি হয় তাকে আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বলে। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অনুসারেই এক্ষেত্রে উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি অধস্তন জনশক্তির নেতা হিসেবে গণ্য হয় এবং তারা ঊর্ধ্বর্তনের নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকে। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ববলেই ঊর্ধ্বতন অধস্তনদেরকে নেতৃত্ব প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদন ব্যবস্থাপক, তার আনুষ্ঠানিক ক্ষমতাবলেই উৎপাদন বিভাগের কার্যাকার্যে নেতৃত্ব প্রদানের অধিকারী হন।

        ২. অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব (informal leadership) : বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক জনগোষ্ঠী একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এদের মধ্যকার গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জন্মস্থান, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছা ইত্যাদি পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এরূপ নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক কোন কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা না থাকলেও দলভুক্ত সদস্যদের উপর তারা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।

খ. প্রেষণার ধরন বিচারে (Basing on types of motivation)

নেতৃত্বের কাজ হল কর্মীদের কাজে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করা। অনুপ্রেরণা কিভাবে সৃষ্টি করা যেতে পারে এ সম্পর্কে নেতৃত্বের চিন্তাধারা, জনশক্তির গান ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাব বিস্তার করে। এসব বিচারে নেতৃত্বকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

        ১. ইতিবাচক নেতৃত্ব (Positive leadership) : একজন নেতা যখন তার অধীনস্থ কর্মীদের আর্থিক বা অন্যান্য উপায়ে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে তাকে কার্যসম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করেন তখন সেই নেতৃত্বকে ইতিবাচক নেতৃত্ব বলে। এ ধরনের নেতৃত্বে নেতা তার অনুসারীদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে কাজ আদায় করতে সচেষ্ট হন। তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য তিনি নানা ধরনের পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। ইতিবাচক নেতা অনুসারীদের শক্তির উৎস হিসেবে মনে করে থাকেন।

        ২. নেতিবাচক নেতৃত্ব (Negative leadership) : নেতা যখন কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার পরিবর্তে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করতে সচেষ্ট হন তখন তাকে নেতিবাচক নেতৃত্ব বলে। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যত কঠোর হয় নেতৃত্ব তত নেতিবাচক হয়। নেতিবাচক নেতার আচরণ প্রস্তুত্বমূলক হয়ে থাকে এবং তিনি নিজেকে বড় ভেবে কর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকেন। কথায় কথায় বরখাস্তের ভয় দেখানো, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া নেতার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

গ. তত্ত্বাবধানের ধরন বিচারে (Basing on types of supervisory)

নেতার তত্ত্বাবধানমূলক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে নেতৃত্বের দু'টি ধরন বা স্টাইল লক্ষ্য করা যায়। যথা:

        ১. কর্মীকেন্দ্রিক নেতৃত্ব (Employee centric leadership) : পরিস্থিতি ও মানবিক দিকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যে নেতৃত্ব কর্মীদের সমস্যার সমাধান ও তাদের কার্যসন্তুষ্টি বিধানের চেষ্টা করে তাকে কর্মীকেন্দ্রিক নেতৃত্ব বলে। মূলত এরূপ নেতৃত্বে নেতারা কর্মীদের মানবীয় চাহিদার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকেন এবং তাদের মনোভাব, আগ্রহ এবং প্রয়োজনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন। এ ধরনের নেতারা কর্মীদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট থাকেন।

        ২. কর্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব (Work centric leadership) : যে নেতৃত্বে নেতা উদ্দেশ্য অর্জনের সুষ্ঠু নীতি ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে কর্মীদেরকে সর্বদা কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন তাকে কর্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব বলে। Stoner, Freeman & Gilbert এর মতে, "Task oriented style closely supervise employees to be sure the task is performed satisfactory." অর্থাৎ, সন্তোষজনকভাবে কার্যসম্পাদনের জন্য কর্মকেন্দ্রিক নেতৃত্ব কর্মীদের নিবিড়ভাবে তত্ত্বাবধান করে। এক্ষেত্রে নেতা কর্মীদের মানবীয় চাহিদা ও সমস্যার ব্যাপারে অধিক মনোযোগী না হয়ে তাদের কাজের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেন। তারা বাস্তব কাজ ছাড়া কিছুই বুঝেন না এবং প্রতিটি কর্মীকে কাজের দ্বারাই মূল্যায়ন করেন।

ঘ. ক্ষমতা প্রয়োগের ধরন বিচারে (Basing on types of using power)

একজন নেতা যেভাবে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করেন সেটি পর্যালোচনা করেও নেতৃত্বের ধরন সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করা যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নেতাদের ক্ষমতা প্রয়োগের ধরনে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এরূপ পার্থক্যজেনে নেতৃত্ব নিম্নোক্ত চার ধরনের হতে পারে।

        ১. স্বৈরতান্ত্রিক বা প্রভুত্বমূলক নেতৃত্ব (Autocratic leadership) : স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বে সকল ক্ষমতা নেতার হাতে এককভাবে কেন্দ্রীভূত থাকে, নেতাই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে কর্মচারীদের সাথে আলাপ আলোচনার কোন সুযোগ রাখা হয় না। নেতা কর্মচারীদের যে আদেশ দিয়ে থাকেন তা বিনা বাক্যে মানতে হয়। এ ধরনের নেতার দাপটে কর্মচারীরা সবসময় ভীত থাকে।

        ২. পিতৃসুলত নেতৃত্ব (Paternalistic leadership) : প্রভুত্বমূলক বা স্বৈরাচারী নেতৃত্বের উন্নত সংস্করণই হল পিতৃথূলত নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে নেতা ও অনুসারীদের মধ্যে গিতা ও সন্তানের সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। নেতা এক্ষেত্রে অনুসারীদের প্রতি সদয় থাকে। অভাব অভিযোগের প্রতি মনোনিবেশ করে এবং হে মমতার মাধ্যমে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করে কাজ আদায়ের চেষ্টা করে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুদের মনোভাবের উন্নতির বহিঃপ্রকাশ হতেই এ ধরনের নেতৃত্বের উৎপত্তি। জাপানে পিতৃসুলভ নেতৃত্ব বর্তমানে সফলতার সাথে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

        ৩. গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব (Democratic participative leadership) : এটি স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ লক্ষ্য করা যায়। নেতা এককভাবে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তিনি কর্মচারীদের মতামত নিয়ে থাকেন। গণতান্ত্রিক নেতা কর্মচারীদের সাথে একযোগে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। যার ফলে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে একটি সামাজিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তাই এরূপ নেতৃত্বে অধস্তন কর্মীবৃন্দ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করে। Douglas MeGregor এ ধরনের নেতৃত্বকে Theory "Y" বলে আখ্যায়িত করেন।

        ৪. মুক্ত বা লাগামহীন নেতৃত্ব (Freemen leadership) : মুক্ত বা লাগামহীন নেতৃত্ব এমন এক ধরনের নেতৃত্বের স্টাইল যেখানে নেতা নামমাত্র নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মীরাই মূলত সকল প্রকার কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকেন। তারা লক্ষ্য নির্ধারণ, কার্যসম্পাদন কিংবা সমস্যা চিহ্নিত করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন। কর্মীরা নিজেরাই তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন এবং প্রেষণার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকেন। এরূপ নেতৃত্বে কার্যত কোন সুবিধা নেই। এক্ষেত্রে অধস্তনরা নেতাকে কোন মূল্য দেয় না। প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ সময়ই বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে এবং অনুসারীরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে এক ধরনের অরাজক নেতৃত্ব।

ঙ. সম্পর্কের দিক বিচারে (Basing on relationship)

মেতা ও অনুসারীদের সম্পর্কের ভিত্তিতে নেতৃত্বকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :

        ১. ব্যক্তিগত নেতৃত্ব (Personal leadership) : যে ক্ষেত্রে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিরাজ করে। এবং নেতা প্রত্যক্ষভাবে তার অধীনস্থদের আদেশ নির্দেশ প্রদান ও কার্যাবলি তত্ত্বাবধান করে তাকে ব্যক্তিগত নেতৃত্ব বলে। প্রতিষ্ঠানের নিম্নস্তরের বা মাঠ পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণ কর্মীদের একেবারে পাশাপাশি বা সামনে থেকে তাদের পরিচালনা করে বিধায় তাদেরকে ব্যক্তিগত নেতৃত্ব বলা যায়। এ ধরনের নেতৃত্ব কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কাজে অংশগ্রহণ করে।

        ২. অব্যক্তিগত নেতৃত্ব (Impersonal leadership): এক্ষেত্রে নেতা ও অধস্তনরা পাশাপাশি বা সামনাসামনি অবস্থান করে না, বরং সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করে। এক্ষেত্রে কতিপয় উপনেতার মাধ্যমে নেতা অধস্তনদের পরিচালনা করে। যেমন- উৎপাদন ব্যবস্থাপক শ্রমিক-কর্মীগণকে সরাসরি নেতৃত্ব প্রদান করে না। এক্ষেত্রে সুপারভাইজার ও ফোরম্যানদের সে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যবস্থাপকের নেতৃত্বকে অব্যক্তিগত নেতৃত্ব বলা যায়।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনা ও সংজ্ঞাসমূহের আলোকে বলা যায় যে, নেতৃত্ব হল এমন একটি শক্তিশালী উপাদান বা কৌশল, যা অধস্তন বিভিন্ন লোকের প্রকৃতি ও স্বরূপকে সামনে রেখে তাদের এমনভাবে পরিচালিত করে যাতে সবাই আস্থার সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলীয় ও সাংগঠনিক উদ্দেশ্য অর্জনে তৎপর হয়। নেতৃত্বের মাধ্যমেই একটি সংগঠনের কর্মীগণ লক্ষ্য অভিমুখী হয় এবং কার্যসম্পাদনে তৎপরতা দেখায়। তাই সাংগঠনিক উন্নয়ন ও লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ