পানি দূষণ কী | পানি দূষণের কারণ, ফলাফল ও নিয়ন্ত্রণে উপায়সমূহ

 

পানি দূষণ কী | পানি দূষণের কারণ, ফলাফল ও নিয়ন্ত্রণে উপায়সমূহ

পানি দূষণ কী

পানি একটি অমূল্য সম্পদ জীবজগতের প্রাণরক্ষাকারী উপাদান হিসেবে বিবেচিত। সাগর, নদীনালা, হ্রদ ইত্যাদির অন্যতম উৎস পানি। বর্তমানে প্রতিনিয়ত মানুষ এ পানিকে দূষিত করছে।

পানি দূষণ হলো পানির উপাদানগত পরিবর্তন সাধন। পানির সদ্ব্যব্যবহার সংরক্ষণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি। কেননা ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পানির গুরুত্ব অনেক।

পানি দূষণ কাকে বলে

যে কোনো কারণে পানির উপাদানগত পরিবর্তন ঘটলে তাকে পানি দূষণ বলে। পানি হচ্ছে জীবের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য উপাদান। আবার দুষিত পানি জীবনশিকারী হয়ে ওঠে। কাজেই পানি দূষণ বলতে পানির গঠনগত এবং অবস্থানগত এমন পরিবর্তনকে বুঝায় যাতে পানি স্বাভাবিক অবস্থায় জীবজগৎ তথা মানুষের যেসব কাজে বা উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো সেসব কাজের জন্য অনুপযোগী বা ক্ষতির আশংকা থাকে। পানি দূষণ কোনো স্থান বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত।

পানি দূষণের কারণ, ফলাফল ও রোধে করণীয় উপায়সমূহের বিবরণ দাও

ভূপৃষ্ঠের মোট আয়তনের প্রায় ৭১% পানি রাশি দ্বারা আবৃত। পানি জীবজগতের জন্য প্রাণরক্ষাকারী একটি অমূল্য সম্পদ। সাগর, নদীনালা, হ্রদ ইত্যাদি পানির অন্যতম উৎস। পানি বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবসমাজের উৎকর্ষ সাধনের সাথে সাথে শিল্পের প্রসার ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানির প্রয়োজনীয়তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এ পানি নানাবিধ কারণে দূষিত হচ্ছে বলে জীবজগতের ওপর তা বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে। পানি দূষণের পিছনে অনেক কারণ বিদ্যমান, আর এ দূষিত পানির প্রভাব মারাত্মক। তাই এ দূষিত পানি রোধ করার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।

পানি দূষণের কারণ

নিম্নে পানি দূষণের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো।

  • ১. পয়ঃপ্রণালির আবর্জনা : শহর ও পৌর এলাকায় বসবাসরত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের মলমূত্র ও বর্জ্য পদার্থ নর্দমাগুলো দ্বারা নদীতে পতিত হয়। আবার বাসাবাড়ি বা লন্ড্রি হতে পরিত্যক্ত ক্লোরাইড, সালফেট প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ নদীর পানিতে পতিত হয়। এতে ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে অজৈব পদার্থে পরিণত হলে ক্রমান্বয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে পানিতে অবস্থিত জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ মারা যায় এবং বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয়ে পানি দূষিত হয়।
  • ২. তাপমাত্রার বৃদ্ধি : পানির সহনীয় মাত্রা থেকে তাপমাত্র অধিক হলে পানি দূষিত হয়। শিল্পকারখানা হতে উত্তপ্ত বর্জ্যপদার্থ সমৃদ্ধ পানি নির্গত হয়ে কোনো জলাশয় বা নদীতে পতিত হলে সেখানকার পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তার অক্সিজেন ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এরূপ পরিস্থিতিতে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনধারণ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে, ফলে অনেক প্রাণি মারা গিয়ে পানিকে দূষিত করে।
  • ৩. শিল্পের আবর্জনা : শিল্পকারখানা হতে নির্গত ময়লা ও বিষাক্ত দ্রব্য নদী বা সমুদ্রের পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। বিভিন্ন রাসায়নিক শিল্পকারখানা হতে নির্গত আবর্জনাসমূহ কাগজের মণ্ড, বস্তু, সার, লৌহ জাতীয় ধাতব পদার্থ, চিনি, চামড়া, রাবার, ওষুধ প্রভৃতি বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। কোক ও প্লাস্টিক কারখানা হতে নির্গত দ্রব্য জীবের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়াও শিল্পকারখানা হতে নির্গত বিষাক্ত আর্সেনিক পানিতে মিশে থাকে। এসব ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদানসমূহ পানিকে দূষিত করে।
  • ৪. মানুষ দ্বারা প্রত্যক্ষ দূষণ : বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ নদী, হ্রদ, পুকুর ও জলাশয়ে গোসল ও বস্ত্রাদি ধৌত করে। ফলে বিভিন্ন জীবাণু ও রাসায়নিক পদার্থ পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করে।
  • ৫. কঠিন আবর্জনা : পলিথিন, রাবার, প্লাস্টিক, অ্যাজবেস্টস প্রভৃতি দ্বারা তৈরি দ্রব্যাদি সহজে নষ্ট হয় না এবং সহজে এগুলোর রাসায়নিক পরিবর্তনও ঘটে না। ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীব এসবের ওপর কোনো ক্রিয়া করে না। ফলে এসব বস্তু পানিতে পড়ে পুঞ্জীভূত হয়ে পানিকে দূষিত করে।
  • ৬. কীটনাশক ও আগাছানাশক ওষুধ : কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে শস্যক্ষেত্রের মড়ক, আগাছা ও পোকা দমনকারী উন্নতমানের ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ধরনের ক্ষতিকর ওষুধসমূহ যখন উদ্ভিদের ওপর ছড়ানো হয় তখন তা মাটিস্থ পানির সাথে মিশে পানিকে দূষিত করে। এছাড়া বৃষ্টির পানির সাথে ওষুধগুলো নদী, জলাশয় ও সাগরে গিয়ে পতিত হয় এবং পানিকে দূষিত করে।
  • ৭. তেজস্ক্রিয় পদার্থ : বর্তমানে গাড়ির জ্বালানি ও আণবিক শক্তি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন পরমাণু ও তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে থাকে। পারমাণবিক চুল্লি ও অন্যান্য পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে নিক্ষিপ্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো বৃষ্টির সময় তা নদীনালা ও সমুদ্রে পতিত হয়, ফলে পানি দূষিত হয়।
  • ৮. এসিড : শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত পরিত্যক্ত এসিডের মধ্যে সালফিউরিক এসিড (H2SO4) ও নাইট্রিক এসিড (HNO3) অন্যতম। এসব এসিড পানির সাথে মিশে পানির অম্লতা বৃদ্ধি করে পানিকে দূষিত করে।
  • ৯. খনিজ তেল : সমুদ্রে তেলবহনকারী ট্যাঙ্কার হতে অপরিশোধিত তেল দুর্ঘটনার ফলে নির্গত হলে তা পানির ওপর পুরু আবরণ সৃষ্টি করে। এছাড়াও ইঞ্জিনচালিত নৌকা, স্টিমার, ট্রলার, লঞ্চ ও জাহাজ হতে তেল নদী ও সমুদ্রের পানিতে পতিত হয়। এতে জলজ জীবকুলের ক্ষতি হয়ে থাকে এবং পানি দূষিত হয়।

পানি দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব/ফলাফল

পানি দূষণের ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণী তথ্য পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।

  • ১. শহর ও বন্দরের পয়ঃপ্রণালির আবর্জনা ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নদী ও সাগরে পতিত হলে পানি দূষিত হয়ে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
  • ২. পানিতে মিশ্রিত পারদ, সীসা, আর্সেনিক প্রভৃতি প্রাণিদেহে সঞ্জিত হয়ে প্রাণীর স্বাস্থ্যহানিসহ মৃত্যু ঘটে। পারস মানবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে।
  • ৩. পুকুর ও নদীতে এছাড়াও নালা নর্দমার পঁচা পানিতে গোসল, বাসনপত্র মাজা ও কাপড়চোপড় ধোয়ার ফলে মানুষের কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় প্রভৃতি মহামারি রোগ হয়ে থাকে।
  • ৪. শিল্পকারখানা থেকে নির্গত দূষিত বর্জা পদার্থ নদীতে বা সমুদ্রে পতিত হলে সেখানকার পানিতে অক্সিজেনের ভাগ কমিয়ে দেয় । এতে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যু ঘটে।
  • ৫. বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ মানবদেহের দৈহিক বিকৃতিসহ ক্যান্সার সৃষ্টি করে।

পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়

পৃথিবীতে পানি দূষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবীর সব পানির প্রায় ৬০ ভাগ দুষিত অবস্থায় আছে; যা গত ৬ দশকে পানি দূষণের মাত্রা প্রায় ৪ ভাগ বৃদ্ধি করেছে। পানির এ দূষণ রোধ করা একান্ত অপরিহার্য। বিশেষ করে প্রযুক্তি উপায়ে, আইনসম্মত উপায়ে এবং মানুষের স্ব স্ব ব্যক্তিগত উদ্যোগে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিম্নোক্ত উপায়ে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

  • ১. বিভিন্ন কীট, ছত্রাক ও আপছানাশক ওষুধ ও রাসায়নিক সার ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার না করে অথবা পরিকল্পনামাফিক এবং সঠিক ও সীমিত পরিমাণ ব্যবহার করার প্রতি গুরুত্বারোপ করলে পানি দূষণ রোধ করা সম্ভব।
  • ২. কম্পোস্টিং টয়লেট স্থাপনের মাধ্যমে পানি দূষণ রোধ করা যায়।
  • ৩. তেলবাহী জাহাজ ও ট্যাঙ্কার হতে তেল যাতে নদী বা সমুদ্রে পতিত না হয়, তার সুব্যবস্থা গ্রহণ করে পানি দূষণ রোধ করা যায়।
  • ৪. প্লাস্টিক, পলিথিন, রাবার প্রভৃতি যেখানে সেখানে না ফেলে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে মাটি চাপা দিয়ে পানি দূষণ রোধ করা যায়।
  • ৫. নবমির্মিত হাইওয়ের নিকটবর্তী স্থানে ও অনাবৃত জমিতে মৃত্তিকা সংরক্ষণকারী উদ্ভিদ লাগিয়ে এবং অধঃক্ষেপণযুক্ত পানি স্রোত নদীতে পড়ার পূর্বেই যাতে পুকুরে সঞ্চয় করা যায়, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করে পানি দূষণ রোধ করা সম্ভব।
  • ৬. শহর ও পৌর এলাকার আবর্জনা ও নর্দমার জঞ্জাল নদী ও খালবিলে পতিত হওয়ার আগে শোধনের সুব্যবস্থা নিলে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
  • ৭. মৃত জীবজন্তু পানিতে না ফেলে মাটিতে পুঁতে চাপা দিয়ে রাখলে পানি দূষণ রোধ করা সম্ভব।
  • ৮. শিল্পকলকারখানায় ব্যবহৃত বর্জ্য পদার্থ পানিতে পতিত হওয়ার আগেই তা দূষণমুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
  • ৯. পানীয় জল সরবরাহকারী সংস্থা দ্বারা সরবরাহকৃত পানির বিশুদ্ধতা ও দূষণের উপস্থিতি নির্ণয় করে পানি দূষণ রোধ করা যায়।
  • ১০. ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পরিবারের সদস্য সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখে অপ্রয়োজনীয় পদার্থের ব্যবহার কমিয়ে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পানি আমাদের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। কেননা সুস্থ দেহের পরিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ পানি। পানির সদ্ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি। পানি দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এজন্য বিশ্ববাসীর উচিত যথাযথ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ